
স্বাধীনতার ৫২ বছরেও কমেনি ধনী-গরীব বৈষম্য
হাসিব বিল্লাহ , এখন টিভি
২৬ মার্চ ২০২৩, ১৩:০৮
আজকের গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ প্রতিবেদন খবর
স্বাধীনতার ৫২ বছরে দেশের অর্থনীতি পরিণত হয়েছে বিশ্বের ৩৫তম বড় অর্থনীতিতে। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এখনও কমেনি ধনী-গরীবের আয় বৈষম্য। এছাড়া দুর্নীতি বন্ধ না হলে স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলবে না বলে মত অর্থনীতিবিদদের।
আকাশে ডানা মেলে উড়ে পাখিরা। মুক্ত আকাশটা ওদের। মানুষের জগৎটাও আকাশের মতো বিশাল। যদিও মাটিতে ঘর, সমাজবদ্ধ বাস। অঞ্চল, ভাষা আর সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে জাতি।
ভিন্ন দুটি জাতি এবং ভিন্ন দুটি ভূখণ্ড নিয়ে ৭৬ বছর আগে যাত্রা শুরু পাকিস্তানের। ২০০ বছরের ইংরেজ শাষণ থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন ডানায় ভর করে প্রগতি আর সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখে বাঙালী।
আবহমান কাল থেকেই ফসল উৎপাদনে এই বদ্বীপের ভূমি বেশ উর্বর। বাংলার সোনালী আঁশ পাটের সুখ্যাতি তখন বিশ্বময়। পাকিস্তানের প্রধান অর্থকারী ফসল পাট, যা কেবল উৎপাদন হতো পূর্ব পাকিস্তানে। বৈদেশিক মূদ্রার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ আসতো এই খাত থেকে। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের পাট শিল্প থেকে আহরিত বৈদেশিক মুদ্রা একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করতো পশ্চিম পাকিস্তান।
রাষ্ট্রীয় আয়ের উৎসস্থল পূর্ব পাকিস্তান হলেও শিল্প কিংবা অবকাঠামো উন্নয়ন হতে থাকে পশ্চিমে। ১৯৪৭ থেকে ৭১, এই ২৪ বছরে রপ্তানি আয়ের ৫ ভাগের ১ ভাগও বরাদ্দ পায়নি পূর্ব পাকিস্তান। ব্যবসা বাণিজ্য আর অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে পিছিয়ে পড়ে পাকিস্তানের পূর্বাংশ। অথচ পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানের।
স্বকীয় জাতীয়তাবোধ, স্বাধীন অর্থনীতি আর জাতীয় স্বাধীনতা। যুগে যুগে বাঙালীর এ স্বাধীনতা কেড়ে নেয় ভিনদেশিরা। বঙ্গদেশে ব্যবসা করতে আসা পর্তুগিজ, আরব কিংবা ব্রিটিশ বণিকরা একসময় অবতীর্ন হয় শাসকের ভূমিকায়। বার বার সে শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাঙালিরা। সবশেষ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ডাক দেন অর্থনৈতিক মুক্তির।
অর্থনৈতিক শোষণের ইতি টানতে স্বায়ত্তশাসনকে কেন্দ্রে রেখে বঙ্গবন্ধু সামনে আনেন ঐতিহাসিক ছয় দফা। বাঙালীর এ মুক্তি সনদের তিনটি দফাই ছিল অর্থনৈতিক স্বাধীনতার। আলাদা কিন্তু বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু, কর ও শুল্ক ধার্যর ক্ষমতা, ও প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের বৈদেশিক বাণিজ্যের আলাদা হিসাবসহ পাকিস্তানের দুই অংশকে ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্রের দাবি তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু।
গণমুখী অর্থনৈতিক মুক্তির এ ৬ দফাই গড়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহামান বলন, রাজনৈতিক মুক্তি সংগ্রাম এবং অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রাম দুটোর সমন্বয়ে কিন্তু ছয় দফা গড়ে উঠেছিলো। তিনি বাংলাদেশকে দেখতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানের বিপরীত, যেখানে একই অর্থনীতির ভিতরে দুটো অর্থনীতি গড়ে উঠছিলো। সেদিক থেকে বাংলাদেশে একটা বৈষম্যহীন, শেষণহীন, সাধারন মানুষের জন্য জনকল্যান মূলক একটা রাষ্ট্রের কথা তিনি চিন্তা করেছিলেন।
এরপর থেকেই পূর্ব বাংলার জনগণের এক নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু। ৭০ এর নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের একের পর এক টালবাহানা। অবশেষে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে বলেন বঙ্গবন্ধু।
২৬ তারিখ শুরু নতুন দেশের যাত্রা, শুরু অধিকার আদায়ের চুড়ান্ত সংগ্রাম। ৯ মাস ধরে শত্রু মুক্ত করার পর, সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারে মাধ্যমে দেশ গঠনের লক্ষ্যে পথচলা শুরু।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যখন তিনি দাড়ালেন সেখানেও কিন্তু তিনি বললেন যে এ স্বাধীনতা ব্যার্থ হয়ে যাবে যদি মানুষকে পেট ভরে খাবার দিতে না পারি, যদি যুবকদের কাজ দিতে না পারি, যদি দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গড়তে না পারি। সুতরাং তার স্বপ্ন কিন্তু একেবারে স্পস্ট, তিনি বাংলাদেশে একটা সাম্যের অর্থনীতি গড়ে তুলতে চান।
৫২ বছরের যাত্রায় নিম্ন আয়ের দেশ থেকে এখন উন্নীত হতে যাচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ এখন বাংলাদেশ। জিডিপির আকার ৮ বিলিয়ন ডলার থেকে এখন ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার। মোট জনসংখ্যা ৮২ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে থেকে কমে এখন তা ২০ শতাংশে। ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট থেকে এখন ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটিতে। মাথাপিছু আয় ৯৪ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। তিন বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি থেকে এখন রপ্তানি আয় ৪৩ বিলিয়ন ডলার। তবে ধনী গরীবের আয় বৈষম্য এখনো কমেনি বলে জানান অর্থনীতিবিদরা। দুর্নীতিরোধ করতে না পারলে স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলবেনা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর বলেন, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এদের প্রধান্য অনেক বেড়েছে এখন। অনুৎপাদনশীল একটা ব্যবসায়ীক শ্রেনী আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে যারা বিনিয়োগ করেন। বৈষম্য বাড়া সত্বেও আমাদের নিচের দিকের মানুষরা মোটামুটি খেয়ে পড়ে আছেন।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহামান বলেন, দেশে আয় বৈষম্য, ভোগ বৈষম্য, সম্পদ বৈষম্য এগুলো বাড়ছে। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখি যে সুশাষনের ব্যাত্যয় হয় যখন নাকি কর খেলাপ, ক্ষণ খেলাপ এগুলো আমরা দেখি।
২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবার পর বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারলে খুলে যাবে সম্ভাবনার দার। প্রযুক্তি জ্ঞান আর দক্ষ মানবসম্পদের হাত ধরে স্বনির্ভর অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
এফএইচ