Ekhon TV :: এখন টিভি

বেনারসি পল্লী

ভারতীয় শাড়ির আগ্রাসন, বেনারসি বানানো ছেড়ে দিচ্ছেন মিরপুরের তাঁতীরা

১১ মার্চ ২০২৩, ১৪:২৯

এক সময়ে বলিউডের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নজর কেড়েছিলো মিরপুরে তৈরি বেনারসি। কালের বিবর্তনে পাওয়ারলুম আর ভারতীয় শাড়ির আগ্রাসনে পিছিয়ে পড়ছে মিরপুরের বেনারসি। এখন শত কোটি টাকার এই বাজারের বেশিরভাগই আসে ভারত থেকে। অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন সম্ভাবনাময় এই শিল্পের প্রায় ৯০ শতাংশ কারিগর।

অহনা, বিয়ের আগ মুহূর্তে খুঁজছেন মনের মতো লাল বেনারসি। নিজের বিয়ের বাজার করতে সঙ্গে এনেছেন মাকে। খুজে নিচ্ছেন নিজের পছন্দের বেনারসিটি।

তিনি বলেন, 'লেহেঙ্গা বা গাউন সাধারণত জাঁকজমকপূর্ণ বিয়েতে পরা হয়। তবে ঘরোয়া অনুষ্ঠান বা আকদের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের ঐতিহ্যই ধারণ করি। তাই বেনারসিতেই আসা।'

দোকানে দোকানে হাকডাকের সাথে পরিচিত এই এলাকার সবাই। তবে দোকানগুলো কেমন জানি ফাকা। গত দশক থেকে ভারতের মিলে তৈরি কমদামি বেনারসি শাড়ির কারণে হোঁচট খেতে শুরু করে নব্বইয়ের দশকে সোনালি সময় পার করা ঢাকাই বেনারসি। যদিও এর চাহিদা কমেনি একটুকুও। আসল মিরপুরের বেনারসী খুঁজে বের করে নিচ্ছেন ক্রেতারা।

এখন আর আগের মতন খুটখুট শব্দ শোনা যায় না এই পাড়ায়। অনেক খুঁজে খুঁজে বের করতে হয় তাতীদের। সেই জৌলুশও আর নেই মিরপুরের বেনারসি পল্লীতে। অলিতেগলিতে দেখা যায় না সুতোর রোদ পোহানো। এখন সে জায়গা করে নিয়েছে, চীন থেকে আমদানি করা সিল্ক সুতা। এতে কমেছে শাড়ির মান।

আবার, নিবন্ধিত তাঁতিরা ১০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পলিয়েস্টার সুতা আমদানি করতে পারতেন। এখন তা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এছাড়াও, খোলা বাজারে সাধারণ আমদানিকারকদের আমদানি করা সুতার জন্য ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। প্রতিটি শাড়িতে প্রায় এক কেজির মতো রেশম সুতা লাগে। যা কিনতে খরচ পড়ে এক হাজার টাকারও বেশি। এতে বেড়েছে শাড়ির, খরচ কমেছে লাভ।

বেনারসি কারিগর বলেন,'আগে রেশম দিয়ে বানাতাম। এখন তো সেই রেশম পাওয়া যায় না সাথে দামও অনেক। অনেক বেশি দাম বেড়ে গিয়েছে। যা আগে ১৫০-২০০ টাকা পাউণ্ড ছিলো তা এখন ৬০০০ টাকা।'

বাহারি নামের এই বেনারসি শাড়ির তাঁতের, অধিকাংশ যন্ত্রই বয়সের ভারে নুয়ে গেছে। তাঁত তৈরীতে খরচ ৫০ হাজারের বেশী। আবার সব কাচামালই স্থানীয়। তবে এসব এখন অতীত, এসবের বদলে জায়গা করে নিয়েছে চীনের তৈরি প্লাষ্টিকের সরঞ্জাম।

একটি বেনারসি তৈরিতে পাঁচ থেকে সাত দিন সময় লাগে। কারিগররা বললেন, সংসার চালানোর জন্য তাদের আয় যথেষ্ট নয়। তাই নতুন পেশায় ঝুকছেন তিন-চার পুরুষ ধরে এই পেশার সাথে জড়িতরা। এছাড়াও, বর্তমানে বাজারে রয়েছে ভারতীয় শাড়ির চোখ রাঙানি। আবার ভারতীয় মেশিনে বোনা বেনারসিসহ বিভিন্ন শাড়ির সাথে পাল্লা দিয়েও পারছেন না তাতিরা।

তাতিরা অভিযোগের সুরে বলেন, 'ভারতীয় শাড়ি সস্তা হওয়ায় আমাদের দেশিয় শাড়ির দাম ঠিকমতো পাচ্ছিনা। এছাড়াও দোকান ভাড়া আর বিদ্যুত বিল বেশি হবার কারণে এই স্বল্প আয় দিয়ে সংসার চালানো কঠিন।'

শাড়ির ব্যবসায়ী বলেন,' ভারতীয় শাড়িগুলো ফুলে থাকলেও গ্রাহকরা ডিজাইনের কারণেই সেই শাড়িই খোঁজেন। যদিও সেই শাড়িগুলোর অধিকাংশই লাইলন সুতা দিয়ে তৈরি। আর আমাদের দেশিয় শাড়িগুলো আসল কাতান সুতা দিয়েই তৈরি হয়।'

মিরপুরে বেনারসি পল্লীর যাত্রা শুরু সেই ১৯০৫ সালে। দেশভাগের পর বিহারী তাঁতিদের হাত ধরে সমান তালে এগুতে থাকে বেনারসি শাড়ির জৌলুশময় ঐতিহ্য। তবে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত গদিঘর তেমন ছিল না বললেই চলে। গদিঘরগুলোয় বেনারসি শাড়ির খুচরা ও পাইকারি কেনাবেচা হতো সাধারণত। সময়ের সাথে আধুনিক শোরুমে পরিণত হয় গদিঘর ।

বর্তমানে মিরপুরে মোট এক হাজারের মতো কারখানা রয়েছে। এছাড়া মিরপুরেই বেনারসির দোকান শতাধিক। আগে এখানে কারখানা ছিল বেশি, দোকান ছিল কম। এখন বেড়েছে দোকান , কমেছে কারখানার সংখ্যা।

মালিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার শাড়ি বেচাকেনা করেন তারা। এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে আগামী তিন থেকে চার দশকে বিলীন হয়ে যেতে পারে মিরপুরের বেনারসি শাড়ি। এই শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের কাছে শিগগিরই পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান সংশ্লিষ্টদের।

বেনারসি পল্লী তাঁতী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ কাশেম বলেন, 'সরকারের পক্ষ হতে বেনারসি তাতিদের জন্য যে জমি বরাদ্দ দেবার কথা তা এখনো পাওয়া যায়নি। সেই জায়গা পাওয়া গেলে তাত শিল্প আবারও জেগে উঠতে পারে। এই শিল্প যদি ঠিক রাখা হয় তবে যে শাড়িগুলো পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে যে শাড়ি আসে সেগুলো আসবে না উপরন্তু আমরাই শাড়ি রপ্তানি করতে পারবো। কারণ আমাদের শাড়ির যথেষ্ট চাহিদা আছে বহির্বিশ্বে।' 

বলিউডের দেবদাস সিনেমায় লাখ টাকার মিরপুর বেনারসী নিয়েছিলেন সংশ্লিষ্টরা। নাম না জানা আরও অনেক হলিউড বলিউডের সিনেমায় দেখা মেলে মিরপুর বেনারসীর। হালের ফ্যাশন ডিজাইনাররাও এখন ট্রেডিশনাল মিরপুর বেনারসীকে নিয়ে তৈরী করছে ভিন্নধর্মী বিয়ের পোশাক।

নিজের নামে পরিচালনা করা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সাফিয়া সাথি বলেন,'শাড়ি আমাদের ঐতিহ্য হলেও আমরা এখন বৈশ্বিক ফ্যাশন বা হালের ফ্যাশন নিয়ে অনেক বেশি প্রভাবিত। এরপরেও গ্রাহকরা চান তিন চারটি অনুষ্ঠানের মধ্যে অন্তত একটি অনুষ্ঠানে বেনারসি পরবেন। পিওর বেনারসি নামে একটি বেনারসি তৈরি হয় যার বুননশৈলি অনেক বেশি নিঁখুত।'

মিরপুর বেনারস্যার প্রতি নারীর ভালোবাসা চিরঞ্জিব। মা দাদীদের বিয়ের বেনারসির মতোই এখনকার মেয়েরাও মিরপুর বেনারসিকেই নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় মুহুর্তের অনুসঙ্গ করে নিচ্ছে।

ডব্লিউএইচ

Advertisement
Advertisement
Advertisement