
কেন দেউলিয়া হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক ব্যাংক?

একসঙ্গে সিলিকন ভ্যালির অনেক গ্রাহক টাকা তুলে নিতে শুরু করে
২২ মার্চ ২০২৩, ১৫:০৬
মামুন শেখ , এখন টিভি
আমেররিকার দুইটি বড় ব্যাংকের পতন হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক এবং নিউইয়ার্কের সিগনেচার ব্যাংক। আমেরিকার ইতিহাসে ব্যাংকিং সেক্টরে এতো বড় বিপর্যন্ত দেখা গেলো দ্বিতীবার। এর আগে এমন পতন হয়েছিলো ২০০৮ সালে যখন ওয়াশিংটন মিউচুয়াল ব্যাংক দেউলিয়া হয়েছিলো। ওই ঘটনার পর বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা দেখেছিলাম। আর তাই এবারও মহামন্দার শঙ্কায় আছেন অনেকে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থিক ব্যবস্থা যদি ভেঙে পড়ে তবে বিশ্বজুড়ে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য।
সিলিকন ভ্যালির সাথে কী ঘটেছে?
সাধারণভাবে দেখলে- আমরা যে টাকা উপার্জন করি তা ব্যাংকে জমা রাখি, যাতে টাকাটা নিরাপদ থাকে। আর আমাদের আমানতের টাকা দিয়েই ব্যবসা করে ব্যাংকগুলো। এরমধ্যে সবচেয়ে সাধারণ যে ব্যবসাটা ব্যাংক করে তাহলো, ঋণ দেয়া। ঋণ থেকে যে সুদ পায় সেটাই হলো ব্যাংকের মূল আয়। এর বাইরে ব্যাংকগুলো আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে থাকে। যেমন- শেয়ার বাজার, সরকারি বন্ড এবং স্বর্ণে বিনিয়োগ।
এবার আসা যাক সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকে। এই ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৮৩ সালে। ক্যালিফোর্নিয়ার সেন্টা কার্লা শহরে এর সদরদপ্তর। শুরুতে এই ব্যাংক রিয়েল স্টেট খাতে বিনিয়োগ করতো। ১৯৯২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার রিয়েলস্টেট মার্কেটের পতন হলে এই ব্যাংককের ২.২ মিলিয়ন ডলার লোকসান হয়। নতুন করে ব্যাংকটি একইরকম সংকটে পড়েছে। তবে এবারের লোকসানের অংক অনেক বড়, যা তারা সামলে উঠতে পারেনি।
নব্বই দশকের শেষ দিকে এসে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক রিয়েলস্টেটে বিনিয়োগ একেবারেই কমিয়ে দেয়। ২০০০ সালের পর থেকে এই ব্যাংক প্রযুক্তিনির্ভর স্টার্টআপে প্রচুর বিনিয়োগ করতে থাকে। ২০১৫ সাল নাগাদ সিলিকন ভ্যালি জানায়, আমেরিকার ৬৫ শতাংশ স্টার্টআপে তারা অর্থায়ন করেছে। ২০২২ সালে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক আমেরিকার শীর্ষ ঋণদাতা ব্যাংকগুলোর একটিতে পরিণত হয়। এর সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ২০৯ বিলিয়ন ডলার।
কোভিড-১৯ মহামারির সময় যখান সবকিছু বন্ধ হয়ে যায় তখন সফওয়ারভিত্তিক কোম্পানিগুলো ফুলেফেঁপে ওঠে। এসব কোম্পানি তাদের বাড়তি অর্থ সিলিকন ভ্যালির মতো ব্যাংকে ডিপোজিট করে। ফলে মার্চ ২০২১-এ এই ব্যাংকে গ্রাহকদের আমানত দাঁড়ায় ১২৪ বিলিয়ন ডলারে। অথচ এক বছর আগেও তা ছিলো ৬২ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংকের হাতে আসা এই বিপুল পরিমাণ অর্থ তারা বিনিয়োগ করে সরকারি এবং করপোরেট বন্ডে। সিলিকন ভ্যালি এমন সময় বন্ডগুলো কিনেছিলো যখন ঋণের সুদ হার অনেক কম ছিলো।
সিলিকন ভ্যালির সামনে খুবই খারাপ পরিস্থিতি এসে হাজির হয়। ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন কারণে বেড়ে যাওয়া মূল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রণে আমেরিকার সরকার ব্যাংকের সুদ হার বাড়িয়ে দেয়। ফলে সিলিকন ভ্যালির কিনে রাখা বন্ডের দাম কমে যায়। যার কারণে বড় লোকসান গুণতে হয় তাদের। কিন্তু এর চেয়েও বড় সমস্যায় পড়ে গ্রাহকদের দিক থেকে।
সুদের হার বাড়ানোর ফলে স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো ঋণ নেয়া কমিয়ে দেয় এবং কোম্পানি চালানোর জন্য আমানতের টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিতে শুরু করে। একসঙ্গে যখন অনেক গ্রাহক টাকা তুলে নিতে থাকলে ব্যাংক বিপদে পড়ে যায়।
কারণ, ইতিমধ্যে ব্যাংক আমানতের অর্থ বন্ড ও অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করে রেখেছ।
সিলিকন ভ্যালি একদিকে বন্ডে বিনিয়োগ করে লোকসানে পড়ে অন্যদিকে গ্রাহকরা টাকা তুলে নিচ্ছিলো। গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে নগদ টাকার জন্য তারা কম দামেই বন্ড বিক্রি করতে শুরু করে। সম্প্রতি তারা ১.৮ বিলিয়ন ডলার লোকসানে ২১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের বন্ড বিক্রি করে।
মড়ার ওপর খাড়ার ঘাঁ পড়ে শেয়ার বাজারে। বন্ডের লোকসানের খবর প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে ব্যাংকটির শেয়ারের দাম পড়তে শুরু করে। গত ৯ মার্চ এই ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৬০ শতাংশ কমে যায়।
প্রায় একইরকম সংকটে পড়ে দেউলিয়া হয় সিগনেচার ব্যাংক। এই দুটি ব্যাংক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে আরও অন্তত ১৮৬টি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে আছে বলে একটি গবেষণায় দেখা গেছে। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার খবর সামনে আসতেই দেশটির অন্যান্য ব্যাংকের গ্রাহকদের মনেও ভয় ঢুকে যায়। অনেক ব্যাংকে আমানতের অর্থ তুলতে জড়ো হতে দেখা যায় গ্রাহকদের। এ অবস্থায় অর্থ সংকটে পড়তে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বহু ব্যাংক। বাইডেন প্রশাসন ব্যাংকের অস্থিতিশীল বাজার শান্ত করতে একাধিক পদক্ষেপ নিলেও দেউলিয়া হওয়ার শঙ্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি এসব ব্যাংক।
এমএস