Ekhon TV :: এখন টিভি

সৌদি-ইরান চুক্তি: ইসরাইল-আমেরিকার সুদিন ফুরিয়ে আসছে?

সৌদি-ইরান চুক্তি: ইসরাইল-আমেরিকার সুদিন ফুরিয়ে আসছে?

সাত বছর পর বন্ধুত্বের হাত বাড়ালো সৌদি আরব এবং ইরান

১৬ মার্চ ২০২৩, ১৬:১০

মামুন শেখ , এখন টিভি

এই একটি ছবি যেনো হাজারো শব্দের কথামালা। সৌদি আরবের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের উপদেষ্টা মুসাদ বিন মুহাম্মদ আল আইবান এবং ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সচিব আলী শামখানি করমর্দন করছেন। দুজনের মুখের হাসিতে নিশ্চিতভাবেই শান্তির আলো খুঁজছেন মধ্যপ্রাচ্যের লাখো কোটি আরব-অনারব। তবে বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় ইসরাইলের এই সুখ সইবে কিনা সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। এর কারণ, ছবির মাঝখানের লোকটি। তার নাম ওয়ান ই। তিনি চীনের ঊর্ধ্বতন কূটনীতিক। দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত আর প্রক্সিযুদ্ধে লিপ্ত সৌদি-ইরানের মধ্যে নতুন করে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হচ্ছে চীনেরই মধ্যস্থতায়। দুই দেশের এই চুক্তিকে অনেকেই দেখছেন, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাবের শেষের শুরু হিসেবে।

সৌদি-ইরান চুক্তি কীভাবে হলো?

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির বাতাস হুট করেই উল্টোদিকে বইছে। সাত বছর পর শান্তির পথে হাটতে শুরু করেছে সৌদি আরব এবং ইরান। বেইজিংয়ে তাদের আলোচনার বিষয়টি আগে জানানো হয়নি। চার দিন আলোচনার পর চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছানোর ঘোষণা দেওয়া হয়।

২০১৬ সালে সৌদিতে প্রভাবশালী শিয়া ধর্মীয় নেতা শেখ নিমর আল নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জেরে তেহরানে দেশটির দূতাবাসে হামলা চালায় ইরানিরা। সেই থেকে দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবসান ঘটে। এরপর থেকেই মুখোমুখি অবস্থানে শিয়া এবং সুন্নি ধারার দুই দেশ। লেবানন, সিরিয়া, ইরাক থেকে ইয়েমেন সব জায়গাতেই দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছাপ ছিলো স্পষ্ট।

সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর দুই দেশ প্রথম আলোচনায় বসে ২০২১ সালের এপ্রিলে। এরপর আরও কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। এগুলোতে মধ্যস্থতা করে ইরাক এবং ওমান। গত ডিসেম্বরে সৌদি সফরে গিয়ে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠক করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং। আর ফেব্রুয়ারিতে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রায়ইসিকে আমন্ত্রণ জানান চীনে। এর এক মাস পর বেইজিংয়ে দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের বৈঠক শেষে গত শুক্রবার (১০ মার্চ) আবার সব ধরনের সম্পর্ক স্থাপনের ঘোষণা দিলো সৌদি আরব ও ইরান।

কী আছে এই চুক্তিতে?

দীর্ঘ বিরোধের পর একে অপরের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে সৌদি এবং ইরান। কূটনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে একমত হয়েছে তারা। দুই মাসের মধ্যে দুই দেশে পরস্পরের দূতাবাস চালু হবে। একে অপরের সার্বভৌমত্বকে সম্মান জানাবে এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে না।

দ্রুতই দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনায় বসবেন। এছাড়া ২০০১ সালে করা নিরাপত্তা চুক্তি সক্রিয় করার পদক্ষেপ নেবে এবং বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়াবে।

সৌদি-ইরান চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল কেন অস্বস্তিতে?

এই চুক্তিকে জাতিসংঘসহ বিশ্বনেতারা স্বগত জানালেও অস্বস্তিতে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল। এই দুই দেশই ইরানকে চরম বৈরি হিসেবে দেখে। ইরানও এই দুই দেশকে সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য এক নম্বর হুমকি বলে বিবেচনা করে। ইসরাইল বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না জানালেও দেশটির গণমাধ্যমের খবরে এটা স্পষ্ট যে, তেহরান এবং রিয়াদের মধ্যে এই সমঝোতা তাদের মোটেই খুশি করেনি।

ইরান-সৌদি দ্বন্দ্বের সবচেয়ে সুবিধাভোগী যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল। দীর্ঘ সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্য যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থ যেভাবে বজায় রেখেছে তাতে ইরান-সৌদি দ্বন্দ্ব বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে শত্রুর শত্রুকে বন্ধু বানিয়ে ফায়দা নিচ্ছে ইসরাইল। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই চুক্তির ফলে ভবিষ্যতে সৌদি-ইরান সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়, সেটি উপসাগরীয় ভূ-রাজনীতির বিন্যাস বদলে দিতে পারে। যা কোনভাবেই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের স্বার্থের অনুকূলে যাবে না।

তবে ওয়াশিংটনের সবচেয়ে বড় অস্বস্তি এবং শঙ্কার জায়গাটি হলো- এই সমঝোতায় চীনের ভূমিকা। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে তথাকথিত শান্তিরক্ষাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের এত দিন যে একক কর্তৃত্ব ছিলো, তা এখন অনেকটাই খর্ব হবে। এই চুক্তিতে চীনের ভূমিকাকে অনেক বিশ্লেষক বৈশ্বিক ক্ষমতার বিন্যাসে বড় ধরণের পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন।

আঞ্চলিক দ্বন্দ্বে একটি পক্ষকে সমর্থন দেয়ার যে পলিসি যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে আসছে তা ওয়াশিংটনকে বিশ্বস্ত মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় থাকতে দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি এবং ইসরাইলের যতো ঘনিষ্ঠ হয়েছে ততই এই দেশগুলোর সংঘাতে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছে। সৌদি-ইরান দ্বন্দ্বে চীন কোনো পক্ষ নেয়নি। ফলে চুক্তির গ্যারান্টর দুই পক্ষেরই আস্থা অর্জন করতে পেরেছে।

অপরদিকে উপসাগরীয় অঞ্চলে যে কোনো ধরণের সংঘাত চীনের কপালে ভাজ ফেলতে পারে। কারণ দেশটির ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পেছনে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির ভূমিকা অনেক বেশি। ফলে এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে চীনের জ্বালানির সরবরাহ নির্বিঘ্ন হবে।

ইরানের সঙ্গে সমঝোতার ফলে ইসরায়েল বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তভাবে দর-কষাকষির সুযোগ পাবে সৌদি আরব। যুক্তরাষ্ট্র এখন সৌদি আরবকে বেশি চাপও দিতে পারবে না। কারণ, চাপ দিলে সৌদিরা আরও বেশি চীনের দিকে ঝুঁকে পড়বে।

গত কয়েক দশক ধরে সৌদি আরবের মতো দেশের একমাত্র টেকসই অংশীদার ছিলো যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এখন তাদের কাছে বিকল্প আছে। চীন তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক দিক দিয়ে অনেক বেশি সমর্থন দিতে পারবে। এমনকি রাশিয়াও সেটা করতে পারবে। আর এই সুযোগটিই নিয়েছে চীন।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের অস্বস্তির আরেকটি দিকটি হলো, ইরানের এই চুক্তি এমন এক সময়ে হলো, যখন ওয়াশিংটন ও পশ্চিমা অংশীদাররা দেশটির ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। কিন্তু তেহরান এখন আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। কারণ, তাদের একঘরে করার চেষ্টা থেকে ইরান এখন বেরিয়ে যেতে পারবে এবং বড় শক্তিধর দেশকে তাদের পাশে পাবে বলে মনে করবে।

এমএস

Advertisement
Advertisement
Advertisement