
বাংলাদেশের যে ভাষায় কথা বলে মাত্র দুইজন

শ্রীমঙ্গলের খারিয়া ভাষায় কথা বলে মাত্র দুইজন
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৪:৩০
মো. ইমরান , এখন টিভি
ভাষার জীবন বৃক্ষের মতো। যত্নের অভাবে একটি গাছ যেমন মারা যায়, তেমনি হারিয়ে যায় ভাষা। বাংলাদেশে বিলুপ্তির পথে আছে ১৪টি ভাষা। এরমধ্যে শ্রীমঙ্গলের খারিয়া ভাষায় কথা বলে মাত্র দুইজন।
খারিয়ার মতো আরেকটি বিলুপ্তপ্রায় ভাষা রেংমিটচা:
পার্বত্য চট্টগ্রামের রেংমিটচা ভাষায় কথা বলে মাত্র ৬ জন। এই ভাষায় যারা কথা বলে তাদের বয়সও ৬০ এর বেশি। ব্যবহারের অভাবে এই ভাষার অর্থ ঐ ছয়জন ছাড়া পরিবারের কেউ বোঝে না।
বাংলাদেশের নৃগোষ্টী ভাষার ডিজিটাইজেশন:
আদিবাসী ভাষাগুলো সম্প্রদায় এমনকি কোনো কোনোটি পরিবার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। ফলে বোঝাই যাচ্ছে এই ভাষাগুলোর সংরক্ষণ করা কতটা জরুরী। আর এখানেই বলতে হয় ‘বাংলাদেশের নৃগোষ্টী ভাষার ডিজিটাইজেশন’ উদ্দেগের কথা। এটি বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের একটি প্রকল্প।
এপ্রসঙ্গে প্রকল্পের পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. মাহবুব করিম বলেন, ‘বিলুপ্তির সম্ভাবনা সহ সবগুলোভাষাকেই আমরা আর্কাইভ (সংগ্রহ) করছি। এগুলো আমাদের ডিজিটাল লাইব্রেরিতে থাকবে। একইসাথে ছয়টি ভাষা যাদের নিজস্ব লিপি আছে সেসব ভাষার জন্য আমরা কিবোর্ড তৈরি করেছি, সেই সাথে তৈরি করা হয়ে ফন্ট।’
নৃ-ভাষাকে সংরক্ষণের পাশাপাশি মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার এ উদ্দ্যেগ অর্থনীতিতে প্রভাব রাখবে বলে মনে করেন প্রকল্প পরিচালক।
লুসাই ভাষার সংগ্রহ:
বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলোকে সংগ্রহ করার কাজটি বেশ জটিল। এরকমই একটি ভাষা লুসাই। সংগ্রাহক দলের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের এই আদিবাসী গোষ্ঠীর তথ্য নেয় ছিল কষ্টসাধ্য।
‘লুসাই ভাষা সংগ্রহ করতে আমাদের কিছুটা বেগ পেতে হয়েছিল কেননা যিনি লুসাইয়ে কথা বলেন তিনি বাংলা বোঝেন না তবে বম ভাষা বোঝেন। তাই আমরা আমাদের বক্তব্য একজন বমভাষীকে দিয়ে বলিয়েছি যা শুনে লুসাই ভাষায় উত্তর দিয়েছেন সে আদিবাসী।’ ভাষা সংগ্রহের এই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানান মেসবাহুল ইবনে মুনীর যিনি বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠী ভাষার ডিজিটাইজেশন উদ্যোগের প্রোগ্রাম অফিসার ও ডেপুটি টিম লিড।
বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল ভবনে চলে প্রকল্পের কাজ। আদিবাসী সম্প্রদায় চিহ্ণিত করা থেকে শুরু করে, তাদের কথা সংগ্রহ ও ডিজিটাইজেশনের পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে হয় কয়েকটি স্তরে।
এপ্রসঙ্গে আদিবাসী ভাষা বিশেষজ্ঞ মাইকেল মৃদুল কান্তি সাংমা বলেন, ‘মাতৃভাষা ইন্সিটিটিউট থেকে আমরা ভাষার তালিকা সংগ্রহ করি। এরপর আদিবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কমিউনিটি মিটিং করি। সে মিটিংয়ে আমরা ডেটাসেট তৈরি করি। ডেটাসেট হলো আমরা কোন কোন বাক্য বলবো, কী সংগ্রহ করবে সেসব নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তথ্যগুচ্ছ।’
‘মূলত দুই উপায়ে ভাষা সংগ্রহ করা হয়। একটি বাংলা বাক্যের আদিবাসী ভাষায় অনুবাদ ও অপরটি আদিবাসী ভাষার কোনো গল্প, ছড়া অথবা স্বতস্ফূর্ত বক্তব্য‘ ভাষা সংগ্রহের এবিষয়টি ব্যাখ্যা করেন ডেটা সংগ্রহ বিশেষজ্ঞ রিবেং দেওয়ান।
তিনি আরো বলেন, ‘তিনটি উপায়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। নির্দেশক, স্বতস্ফূর্ত ও শব্দ-ব্যকরণ। আত্মীয়বাচক শব্দ দিয়ে শব্দ-ব্যকরণ অংশের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া থাকে সরল ও যৌগিক বাক্য। আদিবাসীরা এই যৌগিক বাক্যগুলোকে নিজেদের ভাষায় প্রকাশ করে। নির্দেশক অংশে আদিবাসীরা পরস্পরের সঙ্গে যেভাবে কথোপকথন করেন তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়।’
৪০টি আদিবাসী ভাষার মধ্যে ২৬টির লিখিত রূপ আছে বাকিগুলো মৌখিক। এর মধ্যে হাজং, সাদরি, কোডা ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি এচারটি ভাষা বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে। নিজস্ব লিপি আছে মৈতৈ মণিপুরি, চাক, চাকমা, তঞ্চঙ্গা, মারমা, রাখাইন, উর্দু ও ম্রো। ১৪টি ভাষা ব্যবহার করে রোমান লিপি সেগুলো্ হলো বম, কোল, ককবরক, খাসিয়া, গারো, লুসাই, মাহালি, পাংখোয়া, আবেং, আত্তং, মিগাম, কোচ, খিয়াং ও খুমি। কন্দ, খারিয়া ও রেংমিটচাসহ বাকি ভাষাগুলো মুখেই সীমাবদ্ধ।
নৃগোষ্ঠী ভাষাকে মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য তৈরি করা হবে ওয়েবসাইট, বর্ণমালা আছে এমন ভাষার জন্য কি-বোর্ড ও ইউনিকোড ফন্ট। তথ্য সংগ্রহের জন্য তৈরি করা হয়েছে ওয়েব অ্যাপলিক্যাশন ও অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ। প্রকল্পের যাবতীয় সফ্টওয়্যার ও অ্যাপ দেশের সফটওয়্যার প্রকৌশলীরাই তৈরি করেছেন।
এবিষয়ে ড্রিম ৭১ বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশাদ কবিরকে জানান, ‘এই প্রকল্পের জন্য আমরা কিবোর্ড, ফন্ট ও ওয়েবপোর্টাল তৈরি করা হয়েছে। ভাষাগুলোর সংগ্রহ করা বেশ জটিল তাই এর জন্য প্রয়োজন ডেটা কালেকশন সফ্টওয়্যা ও অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশন। এগুলোও আমরা তৈরি করেছি।
জীবজগতের চারিত্রিক ধারা জিনের মধ্যে থাকে আর ভাষাকে বলা যায় মানব সভ্যতার সাংস্কৃতিক জিন। একটি সম্প্রদায় বেঁচে থাকে ভাষার মাধ্যমে। যোগ্যতমের টিকে থাকার মতো ভাষাকেও লড়াই করতে হয় অন্য ভাষার সাথে। এ লড়াইয়ের মাঝে শব্দ হারিয়ে যায় মৃত্যু হয় একটি ভাষার। তবে হারিয়ে যাবার আগে যদি কিছু ভাষা সংরক্ষণ করা যায় তাহলে অন্তত আগামী প্রজন্ম জানবে তাদের শিকড়ের গল্প।
আইকে