
খরচ জোগাতে হিমশিম অবস্থা অভিভাবকদের
নিয়মনীতি না মেনেই চলছে কোচিং বাণিজ্য
মানা হচ্ছে না আদালতের নির্দেশনা
জাবেদ আবদুল্লাহ , এখন টিভি
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:০৫
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই চালু রয়েছে রাজধানীর অধিকাংশ কোচিং সেন্টার। বন্ধ হচ্ছে না কোচিং ব্যবসা, শিক্ষকদের কোচিং ব্যবসা বন্ধে শাস্তির বিধানসহ নীতিমালা প্রণয়নের পরও তা বন্ধ করা যাচ্ছে না। এক শ্রেণির শিক্ষকরা নানা কৌশলে তাঁদের এই ব্যবসা অব্যাহত রেখেছেন। নামি স্কুলের শিক্ষকরাও নিজ বাসার মধ্যে চালু রেখেছেন কোচিংয়ের আদলে প্রাইভেট পড়ানো।
সকালে শুরু হয়ে বিরতি দিয়ে রাত ৮ টা পর্যন্ত চলে কোচিং ক্লাস। একেকজন শিক্ষার্থীকে দিনে তিন-চার জনের কাছ কোচিং করতে হয়। শিক্ষার্থীরা জানান, অনেক শিক্ষক তাদের কাছে কোচিং না করলে শ্রেণিকক্ষে তাদের হেনস্ত করেন। তাই বাধ্য কহে কোচিং করতে হয়।
অভিভাবকরা জানান, স্কুল কর্তৃপক্ষের 'চাপাচাপিতেই অনেকটা বাধ্য হয়ে' কোচিং করতে হচ্ছে। এক স্কুলেই দিনে দুবার আসতে হয়। গুণতে হয় বাড়তি টাকা।
উদয়ন উচ্চ মাধ্যমি বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, পরিবারের জন্য এটা খুবই ব্যায়বহুল কারন এখন জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে এছাড়া কোচিংয়ে পড়ানোও ব্যয়বহুল হয়ে গিয়েছে।
শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নীতিমালা প্রণয়ন করে ২০১২ সালের জুন মাসে। এ নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষক তাঁর প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং করাতে পারবেন না। অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের একদিনে সর্বোচ্চ ১০ জনকে কোচিং করাতে পারবেন। এই নীতিমালা ভঙ্গের জন্য নানা শাস্তিরও বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।
রাজধানীর নামিদামি স্কুলের শিক্ষকরাই এই কোচিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। একজন শিক্ষক প্রতিদিন ৫-৬টি ব্যাচ পড়ান কোচিং গুলোতে। প্রতি ব্যাচে পড়ে ২০ থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থী। যে সব শিক্ষকরা এই কোচিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তারা অবশ্য বলছেন অভিভাবকদের জোড়াজুড়ির কারনেই তাদের পড়াতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, দশজন সরকার নিয়ম করেছে সেটা আমরা জানি, আমরা চেষ্টা করছি সেই নিয়মের মধ্যে থাকতে। অভিভাকদের একটা চাহিদা থাকে সেজন্য আমাদের পড়াতে হয়। সবাই বন্ধ করে দিলে আমরাও বন্ধ করে দিবো।
আরেক শিক্ষক বলেন, বাচ্চারা যারা কম বোঝে তাদের অভিভাবকরা আমাদের বলে স্যার আমার বচ্চাটা বুঝতেছেনা, একটু যদি আলাদা করে দেখান, এজন্য আমাদের কোচিং করাতে হয়।
যে দুটি বিষয়ের কারণে ১০ বছর ধরে শিক্ষা আইনের খসড়া ঘুরপাক খাচ্ছে, তার একটি হলো কোচিং সেন্টার আর অন্যটি গাইড নিষিদ্ধ থাকবে। তবে দিনে নয়, সন্ধ্যার পর কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা যাবে। তবে বাস্তবে একেবারেই ভিন্ন চিত্র। অন্যদিকে বইয়ের দোকানে হাত বাড়ালেই মিলছে গাইড। খসড়ায় বলা হয়েছিল কোনো ধরনের নোট বই বা গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করা যাবে না। কেউ যদি তা করেন, তাহলে তাঁকে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড করা হবে। কিন্তু বই বাজারের চিত্র তো ভিন্ন কথা বলছে।
মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের গনিতের শিক্ষক আবির বলেন, শত শত বাচ্চারা প্রতিবছর ফেল করছে ওরা ওদের কাছে যেতে বাধ্য করে। বিভিন্ন ধরনের চাপ প্রয়োগ করে।
কেন শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ে যাবেন এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, একটা শিক্ষার্থী পাঁচ ঘন্টা স্কুলে থাকে এর পরে তো কোচিংয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয় বলে আমি মনে করি না।
২০১২ সালের ২০ জুন শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য অবৈধ বলে রায় দেয় হাইকোর্ট। শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা-২০১২ সরকারের সিদ্ধান্তকে বহাল রাখে উচ্চ আদালত। এই নীতিমালার বাইরে গিয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কেউ শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারবেন না। কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালাসহ শিক্ষকদের করা কয়েকটি রিটের ওপর শুনানি শেষে এই রায় দিয়েছেন হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ।
দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম বলেছেন, আদালত কোচিং বাণিজ্য 'অবৈধ' বলে রায় দিয়েছেন। তাই কোচিং চালু রাখা যৌক্তিক নয়।
তিনি বলেন, দুদক বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন এই জিনিসগুলো সরকারকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখা উচিত।
তিনি আরো বলেন, সকাল ছয়টা থেকে নয়টা পর্যন্ত একজন শিক্ষক যদি কোচিংয়ে ব্যস্ত থাকে নয়টার পরে সে যখন স্কুলে গিয়েছে ক্লাস নিবে দেখবেন কখনো তার ওখানে মন থাকবে না।
১৯৮০ সালে করা একটি আইনেও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নোট-গাইড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোচিং আর নোট গাইড অভিভাবকদের উপর আর্থিক চাপ বাড়াচ্ছে। শিক্ষাবিদরা মনে করেন অসুস্থ প্রতিযোগিতা জন্য দায়ি। আর অভিভাব্কদের ধারনা শিক্ষার্থীরা কোচিং বাণিজ্যের কাছে জিম্মি। এর থেকে পরিত্রাণের যেন কোন উপায় নেই।
এফএইচ