
কৃষি-বিপ্লবের পথে ডুমুরিয়া

একসময় এক ফসলের উপর নির্ভর করতে হতো ডুমুরিয়া উপজেলার কৃষকদের
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:৩২
তরিকুল ইসলাম , এখন টিভি
কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা। এখানকার ঘরে ঘরে রয়েছে গবাদি পশু, মাঠ ভরা ফসল আর পুকুর ভরা মাছ। এককথায় বলা চলে কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে ডুমুরিয়া খুলনার জেলার মধ্যে এগিয়ে রয়েছে। যেখানে বছরে উৎপাদন হয় চারশো কোটি টাকার বেশি সবজি। তরুণ উদ্যোক্তারা বলছেন, কৃষিতে নতুন বিপ্লব সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করার চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা।
নবদ্বীপ মল্লিক। কৃষিতে ডুমুরিয়া উপজেলার একজন সফল উদ্যোক্তা। গত ৮ বছরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জাতীয়ভাবে। কৃষিতে উদ্যোক্তা হিসেবে হয়েছেন স্বাবলম্বী। তার উদ্ভাবিত চুই ঝালের চারা এখন শুধু খুলনাঞ্চলে নয়, সারাদেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আবার বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে চুইঝাল। এছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির সবজির চারা উৎপাদন করে বিক্রি করছেন আশেপাশের জেলা ও উপজেলার কৃষকদের কাছে। এতে বছর শেষে আয়ও হচ্ছে ভালো। চুই ঝাল গাছের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- জায়গা কম লাগে এবং সাথী ফসল হিসেবে বেড়ে ওঠে।
নবদ্বীপ মল্লিক বলেন, যারা প্রথমদিকে শুরু করেছিলো তাদের প্রায় সবাই ভালো ফলাফল পেয়েছে। বাংলাদেশের এমন কোন জেলা নাই যেখানে আমাদের চারা যায়নি।
নবদ্বীপ মল্লিকের চুই ঝালের চারা রোপণ করে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। উপকারভোগী এক চাষি বলেন, আমরা এখানে চুইঝাল এবং সজনার চারা নিতে এসেছি।
জৈব সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে এলাকায় সাড়া ফেলেছেন ডুমুরিয়ার বরাতিয়া গ্রামের তাপস সরকার। মাত্র ১০ কাঠা জমিতে তিনি বেগুন চাষ শুরু করেছেন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই। এতে ফলন ও গুণগত মান ও ভাল হয়। রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে প্রতি কেজি বেগুনে ১০টাকা বেশি খরচ হতো। জৈব সার ব্যবহার করলে সে খরচ ২ টাকায় নেমে আসে। সপ্তাহে তার আয় হয় আড়াই হাজার টাকা। অপরদিকে, রাসায়নিক সার ব্যবহারে আয় দাঁড়াতো দেড় হাজার টাকায়।
তাপস সরকার বলেন, রাসায়নিক সারে তাৎক্ষণিকভাবে ভালো দেখা যায়। কিন্তু জৈব সারের কার্যকারিতা অনেক বেশি। আমাদের এখানকার বেগুনগুলো একেবারে সুস্থ সবল এবং রোগমুক্ত।
একই পদ্ধতিকে বছরে তিনবার ফুলকপি, শসা ও সরিষাসহ কয়েকটি জাতের সবজি উৎপাদন করছেন তাপস সরকারের ভাই কাজল সরকার। তিনি বলেন, কৃষি অফিসের সহায়তা নিয়ে লাভজনক হচ্ছে এভাবে সবজি চাষাবাদে।
সকাল থেকে মাঠের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করেন সত্তর বয়সী শুকুর আলী ও মতিন গাজী। এ বছর ফলন যেমন ভালো হয়েছে তেমনি পুরো জমিতে লাভ হয়েছে দেড় লাখ টাকা।
তারা বলেন, আমরা ফুলকপি, পাতাকপি, শিমসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করি। এগুলোর চাষে খুবই ভালো। আমরা এই চাষাবাদ করে খুবই ভালো আছি।
কৃষকের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি এবং ন্যায্য মূল্যে পেতে ২০১৮ সাল থেকে নেদারল্যান্ডস সরকারের ১০ কোটি ১৮ লাখ টাকা অর্থায়নে খুলনার ডুমুরিয়ার টিপনা এলাকায় গড়ে তোলা হয় সর্বাধুনিক ভিলেজ মার্কেট। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আধুনিক এই উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে ৪ বছর যেতে না যেতেই। এখন সবকিছুই শুনশান।
ডুমুরিয়ার ভিলেজ মার্কেট সফলতা না পেলেও দীর্ঘ এক দশকে অপরিকল্পিতভাবে শুরু করা একই উপজেলার ১৮ মাইল এলাকার পাইকারি সবজি বাজার স্থানীয় ও পার্শ্ববর্তী জেলার কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ভোর হতেই কৃষকরা এ বাজারে নিজেদের উৎপাদিত শাক সবজি আর ফলমূল নিয়ে হাজির হন এ বাজারে। ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন তাই কৃষকরা ও খুশী।
২০১২ সালে কয়েকজন কৃষক মিলে এ বাজার গড়ে তোলে। শুধু ডুমুরিয়া উপজেলা নয়, পার্শ্ববর্তী সাতক্ষীরা ও যশোরের কৃষকরাও তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে এখানে বিক্রি করতে আসেন। প্রতিদিন এ বাজারে এক কোটি টাকার বেশি বেচা কেনা হয়ে থাকে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, কৃষকদের প্রশিক্ষণ, উন্নত বীজ সরবরাহ, বিক্রয় ও বিপণনে বছরজুড়েই চলে কার্যক্রম।
ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইনসাদ ইবনে অমীন বলেন, কৃষকদের প্রশিক্ষিত করা এবং আমাদের প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আমরা দেশের ভেতরে বড় বড় সুপার মার্কেটগুলোতেও কৃষকদের যোগাযোগ তৈরি করে দিচ্ছি।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডুমুরিয়ার বহুমুখী কৃষি ও উদ্যোক্তা তৈরির কার্যক্রম একটি আদর্শ হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে দিলে এ খাত থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ডুমুরিয়া উপজেলায় ৩ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে খরিপ-১ ও খরিপ-২ প্রজাতির সবজি চাষ হয়। ৩৩ হাজার কৃষক এ কাজের সাথে জড়িত। বছরে এ উপজেলা থেকে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার সবজি বিক্রি হয়ে থাকে। এর মধ্যে ২০২২ সালে চুঁইঝাল, কাচাকলা, পেঁপে, কচুর লতিসহ ১২টি পণ্য বিদেশে গেছে।
একসময় এক ফসলের উপর নির্ভর করতে হতো ডুমুরিয়া উপজেলার কৃষকদের। কিন্তু এখন চিত্র পাল্টে গেছে। সবুজ শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফল-মূল উৎপাদিত হচ্ছে এই উপজেলায়। পাশাপাশি শক্তিশালী হচ্ছে এখানকার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি এবং তৈরি হচ্ছে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা।
এমএস