Ekhon TV :: এখন টিভি

টিউশন ফি দিতেই হিমশিম শিক্ষার্থীদের

ব্রিটেনে বিপাকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা

'অর্থনৈতিক সংকটে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ নেই'

ব্রিটেনে বিপাকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা

কমেছে আয়ের সুযোগ, অর্থের নিশ্চয়তা

১১ জানুয়ারি ২০২৩, ১৫:৫২

নাঈম হাসান , এখন টিভি

ব্রিটেনের নামিদামি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ হাজার শিক্ষার্থী পড়তে যান। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটে টিউশন ফি যোগাতে হিমশিম সেখানে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদের। বিপদে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাও। 

উচ্চ শিক্ষার গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে ব্রিটেন অন্যতম পছন্দের স্থান। সেই ব্রিটিশ ভারতের সময় থেকেই বিলেতে পড়তে যাওয়ার চল শুরু। কালের পরিক্রমায় পাকিস্তান আমল, স্বাধীন বাংলাদেশ যতোই দিন গেছে এ সংখ্যা কেবলই বেড়েছে।

শিক্ষার মান, ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি, সব মিলিয়ে ব্রিটেন অনন্য। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থী বাংলাদেশ থেকে ব্রিটেনের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে আসেন। এখানকার বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের গুনতে হয় চড়া টিউশন ফি। কিন্তু তাতেও সমস্যা হয় না কারণ স্কলারশিপ, পার্টটাইম জবসহ বিভিন্নভাবেই খরচ উঠিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে প্রেক্ষাপট ভিন্ন।

ব্রিটেনজুড়ে চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। মূল্যস্ফীতির চাকা ছুটছে লাগামহীনভাবে। এতে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি দিয়ে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ছে, যদি না তারা দেশ থেকে অর্থ আনেন।

স্নাতক, স্নাতকোত্তর, পিএইচডি ক্ষেত্র বিশেষে শিক্ষার্থীদের বছরে জনপ্রতি বাংলাদেশি টাকায় ১২ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত টিউশন ফি গুণতে হয়। উচ্চবিত্ত পরিবারের জন্য এ খরচ মামুলি ব্যাপর হলেও, মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীর জন্য এই অর্থ যোগাতে বেশ হিমশিম খেতে হয়। প্রথম সেমিস্টারের অর্থ দেশ থেকে পরিশোধ করে এলেও, পরবর্তী সেমিস্টারের অর্থের যোগান অনেকের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে। বিশেষ করে বর্তমান বাস্তবতায়।

২০২২ সালের মধ্যভাগ পর্যন্ত ১১ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছেন। যা ২০১৯ সালের পর সর্বোচ্চ। করোনা মহামারি চলাকালীন শিক্ষার্থী আসার গড় সংখ্যা অনেকটাই কমে যায়, তবে বর্তমানে সেটি আবারও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। পূর্ববর্তী বরিস জনসন সরকারের নীতিই ছিল, শিক্ষার্থী বাড়াও, অর্থ কামাও। সেই নীতির আওতায়ই, বাড়ছে শিক্ষার্থী। এতে রাজস্ব আয়ের পাল্লা ভারি হচ্ছে সরকারের। ব্রিটেনে সবচেয়ে বেশি পড়তে আসে চীন, ভারত ও নাইজেরিয়ার শিক্ষার্থীরা। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ।

বাংলাদেশ থেকে যারা স্টুডেন্ট ভিসায় ব্রিটেনে আসছেন তাদের বেশিরভাগই প্রাথমিক অবস্থায় বিভিন্ন সুপারশপ, খণ্ডকালীন ইভেন্ট এবং রেস্টুরেন্টে কাজ করে থাকেন। বেক্সিট ও করোনা পরবর্তী সময়ে চাকরির সুযোগ বাড়লেও শিক্ষার্থীদের নিয়মানুযায়ী ২০ ঘণ্টার বেশি কাজের অনুমিত নেই। কিন্তু বর্তমানে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না হওয়ায়, শিক্ষার্থীদের আয়ের সুযোগ হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া ব্রিটেনে পড়াশোনাকালে, ইউরোপের অন্য দেশে গিয়ে কাজের সুযোগ নেই।

স্বপ্নের এই নগরীতে যখন সন্ধ্যা নামে তখন কেউ হিমেল হাওয়ায় গা ভাসিয়ে আনন্দ উদযাপনে মেতে ওঠেন। কেউ আবার টিউশন ফি পরিশোধের চাপ, পরিবারকে টাকা পাঠানো আর থাকা-খাওয়ার খরচ জোগানোর চিন্তায় দিশেহারা। যেন সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এলে নির্বাক নিস্তব্ধতা নেমে আসে প্রবাসী শিক্ষার্থীদের জীবনে। স্বপ্নের দেশে এসে চরম বাস্তবতাকে খুব কাছ থেকেই দেখে মোহ ভাঙে শিক্ষার্থীদের।

উচ্চশিক্ষা ব্রিটেনের জন্য একটি লাভজনক ব্যবসার খাত বলা চলে। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লাখো শিক্ষার্থী এখানে পড়তে আসছেন চড়া মূল্যে টিউশন ফি দিয়ে। এখানে জীবন যাপনের খরচও অনেক। শিক্ষার্থীদের জন্য বেঁধে দেয়া ২০ ঘণ্টার কাজের অনুমতির কারণে অনেকেই বেশি পরিমাণে আয় করতে পারেন না। তাই বছর শেষে টিউশন ফি দেয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক শিক্ষার্থীর জন্য পাহাড়সম চাপ।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ব্রিটেনে উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের আগ্রহের সুযোগ নিচ্ছে মানবপাচারকারীরা। রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ব্রিটেন। অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস না করে অন্যদেশে পালিয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই দালালদের খপ্পরে পড়ে কম মজুরিতে অবৈধ পথে কাজে নিয়োজিত হচ্ছেন বলেও জানায় জানিয়েছে ব্রিটিশ লেবার এবিউজ অথরিটি।

তবে যারা কষ্ট করে এখানে পড়াশোনা শেষ করছেন, তারা কি সৌভাগ্যবান? অনেকেই শিক্ষা অর্জন শেষে দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হন। খুব কম শিক্ষার্থী স্থায়ী বসতি গড়ার সুযোগ পপান। স্টুডেন্ট ভিসায় আসার পরে প্রায় আট থেকে দশ বছর লেগে যায় পারমানেন্ট রেসিডেন্স পেতে। কঠোর ইমিগ্রেশন আইন, পড়াশোনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চাকরি যোগাড় করাসহ রয়েছে বিভিন্ন জটিলতা। তাই চাইলেই ব্রিটেনে স্থায়ী হওয়া যায় না।

ব্রিটেনের আবহাওয়া ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়। কিন্তু দেশ থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের ভাগ্য বদলায় না সহজে। একদিকে পড়াশোনার চাপ, অন্যদিক অর্থ রোজগারের চিন্তা। ভোর না হতেই ছুটতে হয় উপার্জনের আশায়। বিকেলে ক্লাস ধরা। আবার কারো রাত কাটে কাজ করে আর সকাল হলেই হাজির হতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে। এমন জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন দেশ থেকে পড়তে আসা হাজার হাজার শিক্ষার্থী। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য যারা ব্রিটেনে আসতে চান, তারা যেন অর্থ জোগানের বিষয়টি নিশ্চিত করে আসেন।

আর্থিক স্বচ্ছলতার দিকটি নিশ্চিত করেই এখানে আসেন

একটা সময় ছিল, যখন বিলেতে পড়লে ক্যারিয়ার গড়ার অনেক সহজ হতো। বাংলাদেশ থেকে পড়তে এসে অনেকেই এখানে শিক্ষক, আইনজীবি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, ব্যবসায়ীসহ সম্মানজনক পেশায় সফলতার সাথে কাজ করছেন। আগামীতেও বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা আসবেন। মন্দা কেটে গেলে, বর্তমান সংকটও কেটে যাবে। তবে অবশ্যই টিউশন ফি, জীবন-যাপনের খরচসহ সবকিছু যাচাই করে তবেই উচ্চশিক্ষার জন্য আসতে হবে ব্রিটেনে, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। যাতে ব্রিটেনে এসে শিক্ষার্থীদের কোনো ঝুঁকির মুখে পড়তে না হয়।

সম্প্রতি ব্রিটিশ সরকার বিশ্বসেরা ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করা শিক্ষার্থীদের কোনো ঝামেলা ছাড়াই স্থায়ী বসবাসের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এই সুযোগ নিতে পারেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরাও।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এজেন্সিরা বলবেই যে ওই দেশে গেলে পড়ালেখার সঙ্গে প্রচুর টাকা রোজগার করতে পারবেন। এসব প্রলভোনে এশিয়ার বহু দেশ থেকে এখানে এসে বিপদে পড়েন। কারণ এখানের বাস্তবতা খুবই কঠিন। 

আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এখানে এসে প্রথমে আপনাকে অনেক কষ্টের কাজ করতে হবে। আর সেটি না পারলে আপনার পরিবার থেকে অবশ্যই টাকা পয়সা এনে চলতে হবে। এছাড়া টিউশন ফি যে পরিমাণ সেটা চালানো খুবই কঠিন।

ব্রিটেনের অভিবাসন আইনজীবী নাশিত রহমান বলেন, ‘এখানে যেসব শিক্ষার্থীরা আসছেন তাদের একটি মাত্র উপায় হচ্ছে ১০ বছর পর্যন্ত বৈধ ভিসা নিয়ে অবস্থান করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতায় এটা অসম্ভব। শিক্ষার্থী হিসেবে ইউকেতে থাকতে হলে ৪ থেকে ৫ লাখ পাউন্ড খরচ করতে হবে এই ১০ বছরে।’

আকন

Advertisement
Advertisement
Advertisement